Monday, October 17, 2016

আরও ৩০ মামলা, নেই বাচ্চুর নাম

বেসিক ব্যাংকে অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় অন্তত আরও ৩০টি মামলা হচ্ছে। এসব মামলায়ও থাকছে না ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের  সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নাম।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্র জানিয়েছে, প্রায় এক হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা অনুসন্ধান প্রায় শেষ করেছে সংস্থাটির অনুসন্ধান দল। খুব দ্রুত কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেবে দলটি। প্রাথমিকভাবে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান, এমডিসহ দু-তিনজন কর্মকর্তা, ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তা এসব মামলায় আসামি হচ্ছেন, এ বিষয়টি নিশ্চিত। অথচ ঋণ বিতরণের অনেক সিদ্ধান্ত পর্ষদের বৈঠকে অনুমোদন হলেও এর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাইয়ের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায় না দুদক।

এর আগে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনা অনুসন্ধান শেষে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৫৬টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল দুদক। ওই সব মামলায় ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলামসহ আসামি মোট ১২০ জন। এর মধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তা ২৭ জন, কয়েকটি সার্ভে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ১১ জন এবং বাকিরা ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের মালিক। এর মধ্যেও আবদুল হাই বাচ্চুর নাম ছিল না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও কৃষি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলো কে বলেন, বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতির ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে নথিগত প্রমাণ না পেলে বুঝতে হবে দুদক কর্মকর্তাদের নথি বোঝার ক্ষমতা নেই।
তবে দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, এ-সংক্রান্ত অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধানে যাঁদেরই সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাঁদের সবাইকে আসামি করা হবে।
 দুদক সূত্রে জানা গেছে, অনুসন্ধান শেষে প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেওয়া হবে। কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মামলা করা হবে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে অর্থ আত্মসাতের জন্য শেখ আবদুল হাইকে দায়ী করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও ওই জালিয়াতির সঙ্গে আবদুল হাই বাচ্চু জড়িত বলে একাধিকবার উল্লেখ করেন। এমনকি সংসদেও অর্থমন্ত্রী বিষয়টি তুলেছিলেন। গত বছরের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী হল-মার্ক কেলেঙ্কারি ও বেসিক ব্যাংক জালিয়াতি নিয়ে বলেছিলেন, ‘জালিয়াতদের ধরতে বাধা নিজের দলের লোক।’ আবার অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করে দুদককে কমিটিতে তলব করলেও দুদকের কোনো কর্মকর্তা তাতে হাজির হননি। তারপরও ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন আবদুল হাই বাচ্চু।
বেসিক ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, সাবেক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বেই ৮ থেকে ১০ জনের একটি চক্র ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতে মূল ভূমিকা রেখেছে। জালিয়াতির ক্ষেত্র তৈরি করতে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্য ব্যাংক থেকে নিজেদের পছন্দের কয়েকজনকে গুলশান, শান্তিনগর ও প্রধান শাখায় নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের মাধ্যমেই বড় বড় ঋণ প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। সূত্রটি আরও জানায়, অন্তত ৩২টি বড় ঋণ দেওয়ার ঘটনায় ব্যাংকের কোনো শাখা বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দপ্তর থেকে কোনো প্রস্তাব বোর্ডের কাছে উত্থাপন করা না হলেও শুধু বোর্ডসভার কার্যবিবরণী দিয়েই ঋণ অনুমোদন করা হয়। একার সিদ্ধান্তেই ৬০০ কোটি টাকারও বেশি ঋণ দিয়েছেন সাবেক এই চেয়ারম্যান।
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলো কে বলেন, সাবেক পর্ষদ চেয়ারম্যানকে বাদ দিয়ে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় তা আরও বিতর্কিত হবে। বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় ব্যাংকটির সে সময়ের পরিচালনা পর্ষদের সংশ্লিষ্টতার কথা শুধু গণমাধ্যমই উপস্থাপন করেনি। সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক মন্ত্রী, অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরসহ অনেকেই বলেছেন। নথিপত্রেই তাঁদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন। তাই বিষয়টি আরও নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের দিয়ে অনুসন্ধান জরুরি।
গত বছর করা ৫৬ মামলায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯ কোটি টাকা। বাকি আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনার অনুসন্ধানে পরে আবারও অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়। পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে দলটি প্রাথমিকভাবে ৩০টির মতো প্রতিষ্ঠান নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। এসব কোম্পানি হলো: দিলকুশা শাখা থেকে ঋণ নেওয়া বেলায়েত নেভিগেশন, নোভা অটো বাইক ও গাজী অটো ব্রিকস, শান্তিনগর শাখার গ্রাহক এক্সিভ ট্রেড, অ্যাগ্রো ব্যালেন্স ফার্টিলাইজার, হার্ব হোল্ডিংস, মোমেন সরকার টেক্সটাইল ও আখোয়ান ট্রেড। এ ছাড়া রয়েছে গুলশান শাখার গ্রাহক ডেল্টা সিস্টেমস, মা টেক্স, শিপান শিপিং, এফ এ ট্রেডিং, এফ রিসোর্সেস শিপিং, ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজ, এফ সুহি শিপিং, এবি ট্রেড লিংক, ওশান অ্যান্ড ডিজাইন, এফটিএন এন্টারপ্রাইজ, এফ এন জে স্টিল, ওয়েস্ট কোস্ট শিপ বিল্ডিং, শামস ট্রেডিং, ওয়াটার হেভেন করপোরেশন, নিউ এরা ট্রেডিং এবং ফোর এস স্টিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বেসিক ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের মার্চে তা দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। ওই চার বছর তিন মাসে ব্যাংকটি ৬ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়, যার প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকাই নিয়ম ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

No comments:

Post a Comment