হতদরিদ্রের হার কমাতে বাংলাদেশ যে ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে, তা পুরো বিশ্বকেই আশাবাদী করেছে বলে মন্তব্য করেছেন সফররত বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। একই সঙ্গে তিনি আশাবাদ জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ সাফল্যের এ ধারা অব্যাহত রাখবে। পাশাপাশি সারা বিশ্বও একই কাজ করবে।
হতদরিদ্র ও অতিদারিদ্র্যের হার কমাতে বাংলাদেশের সাফল্যের
ভূয়সী প্রশংসার পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট কিছু উপদেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন পূরণ
করতে হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে হবে। সেই সঙ্গে আরও বেশি ও
উন্নত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষ জোর দিতে হবে জ্বালানি ও যোগাযোগ
অবকাঠামোতে। মানসম্মত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুশাসনে আরও বেশি উন্নতি করতে
হবে। আর শক্তিশালী করতে হবে দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ড।
গতকাল সোমবার বিকেলে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে দেওয়া বক্তব্যে এসব প্রশংসা ও পরামর্শ তুলে ধরেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যবিমোচন দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংক যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। যেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট।
এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বিশ্বব্যাংকের
দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যানেট ডিক্সন বক্তব্য দেন। মূল
প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ পল রোমার। আর
ধন্যবাদ জানান অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মেজবাহ উদ্দীন।
দিবসটি পালন এবং বাংলাদেশের সাফল্য উদ্যাপনের সঙ্গী হতে
প্রথমবার তিন দিনের সফরে এসেছেন বহুজাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের
প্রধান। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক মঞ্চে বসে
সাফল্যের প্রশংসা এবং ভবিষ্যতের জন্য পরামর্শ তুলে ধরার পর একই মিলনায়তনে
অপর এক মুক্ত আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন জিম ইয়ং কিম। সে সময় বিশ্বব্যাংকের
প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন, বাংলাদেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ আর নতুনত্বের সঙ্গে
থাকবে বিশ্বব্যাংক।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) জানিয়েছে, অনুষ্ঠানে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অংশীদারত্ব আরও
জোরদার করার আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘দেশের উন্নয়ন প্রয়াসে আমাদের
অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক আরও জোরালো ভূমিকা রাখবে।’ তিনি বলেন,
‘বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত সাহসী, দৃঢ়চেতা ও পরিশ্রমী। ইতিমধ্যে আমরা
মানব-উন্নয়ন সূচকে মধ্যম শ্রেণির দেশ এবং মাথাপিছু আয় বিবেচনায় নিম্ন মধ্যম
আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ২০৪১ সালের
মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ।’
প্রধানমন্ত্রী বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদের বিস্তারের বিষয়টি
তুলে ধরে বলেন, ‘বিশ্ব আজ সন্ত্রাস এবং সহিংস জঙ্গিবাদ নামক দুটি
চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে আমার সরকার “জিরো
টলারেন্স” নীতি গ্রহণ করেছে। জঙ্গিবাদের অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করতে
ভবিষ্যতে জঙ্গিবাদ দমন কার্যক্রমকে আরও শাণিত করা হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব
আমাদের দেশের উন্নয়নের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে
বাংলাদেশ এখনো বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। জলবায়ুসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক
বিভিন্ন তহবিল, বিশেষ করে “গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড” সৃষ্টি অনেক প্রত্যাশার
জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহ আশানুরূপ
অর্থ পায়নি।’
অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী হাবিব ওয়াহিদ নিজস্ব সুর ও কথায় ‘অ্যান্ড পভার্টি’ শীর্ষক একটি ভিডিও সংগীত পরিবেশন করেন। এ ছাড়া সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নামে একটি তথ্যচিত্রও প্রদর্শিত হয়।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট
সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে বলেন, ১৯৯১ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে
বাংলাদেশ ২ কোটি ৫ লাখ লোককে দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলে এনেছে। তবে এখনো
বাংলাদেশের আরও অনেক কাজ করার আছে। এ সময় তিনি বলেন, বিনিয়োগ পরিবেশ
উন্নয়ন, সুশাসন শক্তিশালী করা এবং বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে
বাংলাদেশের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে আগ্রহী বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশে সরাসরি
বিদেশি বিনিয়োগ এখনো বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে কম। যদি সুশাসন বাড়ানো সম্ভব
হয়, তাহলে তা কর্মসংস্থান বাড়াতে সহায়তা করবে।
এই আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যনিরসন: বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বিনিময়। এই আলোচনায় বাংলাদেশ কীভাবে দারিদ্র্যবিমোচনে সফল হলো, তা তুলে ধরেন বক্তারা। আবার পুরোপুরি দারিদ্র্যবিমোচনে কী পরিকল্পনা নেওয়া উচিত, তা-ও উঠে আসে।
আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন
চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা
কামাল, অ্যাকশনএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির ও মোহাম্মদী গ্রুপের
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রুবানা হক। বক্তারা সবাই বাংলাদেশের
দারিদ্র্যবিমোচনে সরকারি নীতি সহায়তা, বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ, নারীর
ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন সাফল্য তুলে ধরেন।
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘দারিদ্র্যবিমোচনে
বিশ্বব্যাপী নতুন উদ্ভাবনী ধারণা খুঁজে বেড়াই আমরা। বাংলাদেশে
দারিদ্র্যবিমোচনের অনেক উদ্ভাবনী ধারণা আছে। গত ৪০ বছরে বাংলাদেশ
দারিদ্র্যবিমোচনে অনেক উন্নতি করেছে। দেশের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে; যা
অর্থনীতিকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে সহায়তা করছে। সমৃদ্ধ আগামীর জন্য আমরা
বাংলাদেশের পাশেই থাকব।’
অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন সিএনবিসি টিভি
১৮-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক শিরিন বান। অনেকটা মুক্ত আলোচনার ঢঙে তিনি
আলোচনা সভা পরিচালনা করেন।
দারিদ্র্যবিমোচনের মূলমন্ত্র কী—সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের
জবাবে অর্থমন্ত্রী সোজাসাপটা উত্তর দেন, ‘বিনিয়োগ পরিকল্পনা-খরচ-সুযোগ
তৈরি।’ তাঁর মতে, বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য হলো মানুষের জন্য সুযোগ তৈরি করতে
পারছি কি না।
বাংলাদেশে গরিব মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা কি
চ্যালেঞ্জ—সঞ্চালকের প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, পল্লি এলাকায়
অবকাঠামো খাতে বিপুল বিনিয়োগ করা হচ্ছে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে।
ভর্তুকি সম্পর্কে তিনি বলেন, ভর্তুকির সংজ্ঞা বদলে গেছে। পাঁচ লাখ পরিবারকে
স্বল্পমূল্যে চাল দিচ্ছে সরকার। এটা ভর্তুকি নয়; সরকারের দায়িত্ব।
দারিদ্র্যবিমোচনে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব সম্পর্কে
পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের
(জিডিপি) ৮২ শতাংশই আসে বেসরকারি খাত থেকে। তাই বেসরকারি খাতের অবদানই
বেশি। সরকার বেসরকারি খাতকে নানা ধরনের নীতি সহায়তা দিয়ে থাকে। এ ছাড়া
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক। কাজের সুযোগ এখানে দরজায় কড়া নাড়ে।
দ্রুত নগরায়ণ প্রক্রিয়ায় দারিদ্র্যবিমোচন যথাযথভাবে
গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দিয়ে পল রোমার বলেন, বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে।
এখন দেখার বিষয়, গ্রাম থেকে আসা গরিব মানুষের জন্য শহর এলাকায় কীভাবে
কর্মসংস্থান ও মানসম্পন্ন জীবনধারণের সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে। শহরে কাজের
অনেক সুযোগ আছে; কিন্তু গ্রামে কম। উন্নয়ন টেকসই করতে শহর ও গ্রামে এ সুযোগ
তৈরির ব্যবধান কমাতে হবে।
নারীর ক্ষমতায়ন কীভাবে হচ্ছে—এমন প্রশ্ন করা হয় জাতীয়
সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে। তাঁর জবাব, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক,
সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে। নারীরা অর্থনৈতিকভাবে
স্বাবলম্বী হয়ে দারিদ্র্যবিমোচনে সহায়তা করছে। এ ছাড়া মাতৃমৃত্যুর হার
হ্রাস, মাতৃস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, শিক্ষায় ভাতাসহ বিভিন্ন খাতে সামাজিক
সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আবার স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত
জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছেন নারীরা। তাঁর মতে, এ তিন খাতে নারীর
ক্ষমতায়ন হলে সমতার ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন হবে।
তবে নারীর ক্ষমতায়নে মানসিকতা পরিবর্তন বড় চ্যালেঞ্জ বলে
মনে করেন রুবানা হক। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি যখন তৈরি পোশাকের
কারখানার কোনো ফ্লোরে যাই, তখন তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে পুরুষ কর্মীকেই বেশি
দেখতে পাই। কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁরা (পুরুষ তত্ত্বাবধায়ক) বলেন,
নারীদের এ পদে আগ্রহ কম। পরে নারী কর্মীদের জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁরা বলেন,
আগ্রহ আছে। নারীদের তত্ত্বাবধায়ক পদে দেখার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
নারীদের দক্ষতা বাড়িয়ে উৎপাদন খাতে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে, যা
দারিদ্র্যবিমোচনকে আরও দ্রুততর করবে।’
সামাজিক খাতে উন্নয়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি খাতের
বহুমাত্রিক সহায়তার ওপর গুরুত্ব দেন আরেক আলোচক ফারাহ কবির। তবে সামাজিক
খাতে এ ধরনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন তিনি। তিনি উদাহরণ
দেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি বহুমাত্রিক অংশীদারত্ব থেকে
সারা বিশ্ব শিক্ষা নিতে পারে। তাঁর মতে, বাল্যবিবাহের কারণে নারীদের কাজে
লাগানোর সুযোগ হারাচ্ছে বাংলাদেশ।
উৎস : প্রথম আলো
No comments:
Post a Comment